তথ্য সংগ্রহে, শাবণ মোস্তাফিজঃ বাংলাদেশের পরিবেশ ভারসাম্য দূষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত যেভাবে, বাতাসে সিসা, পানিতে- আর্সেনিক, চালে- ক্যাডনিয়াম, মাছে- ফরমালিন, ফলে- কার্বাইড, ফলের রসে ও বিস্কিটে বিভিন্ন ইন্ডাসট্রিয়াল- রঙ, সবজিতে কীটনাশক, মুরগির মাংসে- ক্রোমিয়াম সর্বদিকেই একি অবস্থা আমরা যাব কোথায়?
শস্য উৎপাদনে বৃদ্ধি ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসল এর রক্ষার জন্য এদেশে ৭০ দশকে শুরু হয়েছিল সার ও কীটনাশক। ফসল আবাদ বৃদ্ধির কারনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মাত্রাধিক হারে। দেশের অনেক শিল্পাঞ্চল এলাকার উত্তম আবাদি জমি আজ পরিবেশ দূষণের শিকার মারাত্মক ভাবে।কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য গিয়ে মিশছে নদী-নালা, খাল-বিল সহ বিভিন্ন স্থানে। খাল-বিলের পানি ব্যবহৃত হচেছ জলাশয়ের আশপাশের চাষের জমিতে। আবাদি জমি হারাচ্ছে উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতার মাত্রা। শিল্পের বর্জ্যরে মাধ্যমে এসব এলাকার মাটিতে জমা হচ্ছে ভারি ধাতব বস্তু যা পরিপ্রেক্ষিতে ওইসব এলাকার উৎপাদিত চালে ক্যাডনিয়াম পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ‘বেশি ওষুধ বেশি পোকা, কম ওষুধ কম পোকা’-এ প্রতিপাদ্য কে সামনে নিয়ে আইপিএম, আইসিএম বর্তমানে আইএফএম বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্লাবের সদস্যদের প্রচার-প্রচারণা ও মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের তদারকির ফলেই বালাইনাশকের ব্যবহার কমতে শুরু করেছে। এর ফলে, পুরো দেশে যেখানে ২০০৮ সালে দেশে বালাইনাশক ব্যবহার হয়েছিল ৪৮ হাজার ৬৯০ এর অধিক মেট্রিক টন, কমে দারিয়ে ২০১২ সালে তা ৪০ হাজার ৮৮২ মেট্রিক টন এ এসেছে। দেশে আইপিএম, আইসিএম ক্লাবের বর্তমান সংখ্যা ১০০০০টি ও প্রশিক্ষিত চাষির সংখ্যা ৩০০০০০ জন। আগামীতে পরিকল্পনা রয়েছে ২০০০০টি আইপিএম/আইএফএম ক্লাব স্থাপনের। এ ধরনের কৃষক সংগঠনের মাধ্যমে কীটনাশকের জুডিশিয়াল/পরিমিত ব্যবহার, পরিবেশ রক্ষায় কীটনাশকের পরিবর্তে সবজিতে ফেরোমেন ট্রাপ, ব্রাকন, ট্রাইকোগামা ব্যবহার বৃদ্ধি করা, ধানের জমিতে পার্চিং করা ও ফল পাকানোতে প্রাকৃতিক পদ্ধতি অবলন্বন করে ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য মিশানো পরিহার করা এবং এর ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে পত্রপ্রত্রিকায় ও রেডিও-টেলিভিশনে ব্যাপক প্রচার করা হবে। অন্তত বাঁচার তাগিদেই এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
একদিকে কমে যাচ্ছে আবাদি জমি, অন্যদিকে ফসলি জমিতে বেআইনিভাবে ইটভাটা স্থাপন করার কারণে তার কালো ধোঁয়া আশপাশের ফসলি জমি এবং আশেপাশের গাছ পালার ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রতি বছর দেশের কোথাও না কোথাও ধানে চিটা, ফসলহানীসহ ফল গাছ ও ফলশূন্য হওয়ার মত অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে। যদিও শেষ ২০১৩ সালে কয়েটি উপজেলার বোরো ধানের জমি এতে অক্রান্ত হয়েছে। আমাদের কৃষি প্রকৃতি অনেকটা নির্ভরশীল জলবায়ুর ওপর। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে কৃষি ওপর পড়ছে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব। এর ফলে দেখা দিচ্ছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ভূমিকম্প সহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
নদ-নদীর উৎস পথে বা তার গতিপথে বিভিন্ন ভাবে বাধা সৃষ্টিকারী বাঁধ সৃষ্টি করছে পানির স্বল্পতাসহ খরার। উজানে বিভিন্ন অপরিকল্পিত বাঁধ তৈরি করা যা ভাটিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর কারণে বাংলাদেশে কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশ ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু তাই নয় বাড়ছে পানির উজানমুখী ধাক্কা।
কারণ খরার সময় উজানের পানি প্রবাহ বাধার কারণে নদীতে কমে যাচ্ছে পানির পরিমাণ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এবছর বরেন্দ্র অঞ্চলসহ বিভিন্ন উপজেলার ৩৮০টি অগভীর নলকূপ ৮-১০ ফুট গভীরে স্থাপন করে সেচ প্রদান করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ এর চরাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ৪৪,০০০ হেক্টর যাহা নদীর নাব্যর কারণে বছরে বছরে বেড়েই চলেছে।
নদীতে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের বিস্তৃর্ণ এলাকা লবণাক্ত পানিতে ভরে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশের ১০ লাখ হেক্টর জমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত।
এর মধ্যে মাত্র ২,৫০,০০০ হেক্টর জমিতে লবণসহিষ্ণু ফসল চাষা করা সম্ভব হচ্ছে। বাকি বিপুল সংখ্যক জমি এখনও চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। দেশের ১২টি জেলায় লবণাক্ততার প্রভাবে স্বাভাবিক চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। ২০০৭ ও ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় এ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জমি লবণাক্রান্ত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি করেছে। যা এখনও কাটিয়ে উঠা হয়নি।
তাপমাত্রা ও উষ্ণতা রোধে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের কোন বিকল্প নেই। একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫% গাছপালা অথবা বন থাকা দরকার, আমাদের দেশে রয়েছে বর্তমানে মাত্র যার ১০-১২%। এ সমস্যা উত্তরণের জন্য সরকার বৃক্ষরোপণ অনেক বেশি জোর দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় কিছু আগ্রাসী প্রজাতির গাছপালা আমাদের দেশকে মরুময়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেশে বিভিন্ন স্থানে রাস্তার দুইপাশে কড়াই গাছ বাগান আকারে চাষ করা হচ্ছে। যে সব গাছে পাখি বাসা বাঁধে না, মৌমাছি মধু আহরণ করে না এবং আমাদের ভূ-নিম্নস্থ পানি ব্যাপক শোষণ করে উড়িয়ে দিয়ে দ্রুত মরুময়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগতভাবে নিচের দিকে নামছে, যার ফলে পানিতে আর্সেনিকসহ নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ বাড়ছে। এর পরেও যদি এ ধরনের গাছ লাগানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় যাবে তাহা সহজেই বুঝা যায়। অথচ আমরা এর পরিবর্তে বিভিন্ন গাছ যেমন বেলজিয়াম, একাশিয়া, ইপিল-ইপিল, মেহগনি ইত্যাদি কাঠের গাছের সাথে ফল গাছ (আম, জাম, কলা, লিচু, পেয়ারা, কাঁঠাল, তাল, খেজুর ইত্যাদি) লাগিয়ে একদিকে পরিবেশের উন্নতি সাধন অন্যদিকে ফলের চাহিদা ও পূরণ করতে পারি তবে তা করছি না।
দেশে প্রতি বছর প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন এর বেশি বীজ ব্যবহার হয় এর মধ্যে বিএডিসি সরবরাহ করে মাত্র ধানের ৩৫-৪০ ভাগ এবং অন্যান্য ফসলের মাত্র ১০-১২ ভাগ। সরকার ভালো মানের বীজ সরববাহের লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে (ডিএই) কৃষক পর্যায়ে ভিত্তি বীজের প্রদর্শনী স্থাপন করে এ সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত। কৃষক পর্যায়ে উৎপাদিত এ ধরনের বীজ দিয়ে বর্তমানে প্রায় ৭০ ভাগ উন্নত মানের ধান বীজ এর চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়েছে। সরকারের নন ইউরিয়া সারের মূল্য কমানো এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তদারকির ফলে বর্তমানে জমিতে সুষম সারের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটা। ফলে বিগত ৫(২০১৫-২০২০) বছর ধরে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফল স্বরূপ ৩ বছর ধরে এক টন চালও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়নি দেশে। এত প্রতিকূল পরিবেশেও কৃষি উৎপাদন বিগত ৫ বছর শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে এতে দেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও অনেক উন্নত দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছে।
আমরা জানি কৃষিতে নানাবিধ সমস্যা থাকলেও যার সমাধান ও রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষির দিক দিয়ে অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থান এ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি যেটি চাল উৎপাদন যা যথেষ্ট তা ধরে রাখতে হবে। বিগত বছরে ১ লাখ টন চাল রপ্তানি হচ্ছে অন্যদেশে। দেশে গমের জাত উদ্ভাবনের ফলে গমের আবাদ বৃদ্ধি হচ্ছে অনেক। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৫ লাখ টন এর বেশি গমের চাহিদা রয়েছে, যার উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১১-১২ লাখ টন। যার জন্য খাদ্যশস্য হিসেবে প্রতি বছরই প্রায় ২৫-২৭ লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৮০ লাখ টন এর বেশি আলু উৎপাদন হচ্ছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে কিছু সংখ্যক বিদেশে ও রপ্তানি হচ্ছে। এ মহূর্তে যেটা জরুরি সেটা হল সবজি ও ফলের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে এবং উৎপাদন বাড়াতে হবে। এদিকে ডাল ও তেল জাতীয় ফসলে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি বিভিন্ন দেশের চেয়ে। ভোজ্যতেলের প্রায় অর্ধেক এর বেশি আমদানি করতে হচ্ছে। যদিও দেশে সরিষার আবাদ বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। নতুন নতুন সরিষার জাত উদ্ভাবিত হয়েছে যা উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ডালের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ফলে ডাল জাতীয় ফসলের উৎপাদন এরই মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। যার ফলে কমেছে ডালের মূল্য ও আমদানির পরিমাণ। বর্তমানে চাহিদার ৫০% ডাল দেশে উৎপাদন হচ্ছে। চাষিরা মূল্য পাওয়ার কারণে পেঁয়াজ-রসুনের উৎপাদন বেড়েছে এবং আমদানিও কমেছে। সারা বছরব্যাপী ফল উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কলা, পেঁপে, থাই পেয়ারা, আপেল কুল চাষ বেড়েছে অনেক বেশি। অল্প বৃষ্টি নির্ভর আউশ ও পুরো বৃষ্টি নির্ভর রোপা আমন চাষে সরকার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে এ বছর। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কৃষি খামার স্থাপন, খামার যান্ত্রিকীকরণ ও সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিরলস প্রচেষ্টা বর্তমান কৃষিকে একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ অবস্থানে নিয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেখানে রক্ষিত হবে কৃষি, কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করে সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।