তথ্য সংগ্রহে, শ্রাবণ মোস্তাফিজঃ অত্যন্ত সমৃদ্ধে ভরপুর বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। পরিবেশ – প্রতিবেশব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্যের উপর নেমে আসে বিপর্যয় যখন প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকৃতিতে বিদ্যমান নদ-নদী, হাওর, পাহাড়, বন, ইত্যাদির কর্যকরি ভূমিকা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে আমরা দিনের পর দিব এগুলো ধ্বংস করেই চলেছি।
নদ-নদী দখল-ভরাট-দূষণ, বন উজাড়, পাহাড় কাটা, দারিদ্র, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পানি ও বায়ু দূষণ, শিল্পকারখানার দূষণ, মাএাতিরিক্ত ও ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার, ভ’গর্ভস্থ পানির অত্যাধিক উত্তোলনে আমাদের দেশের পরিবেশ আজ অনেকটা বিপর্যস্ত। যার কারণপ হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। সাথে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর, জলাশয় কে বলা যায় বাংলাদেশর প্রাণ। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষা এবং নৌ চলাচল, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে নদীর গুরুত্ব অনেক বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ছোট বড় ৩০০ টির বেশী নদ-নদী রয়েছে। তবক এর মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ৩টি মিয়ানমারের সাথে সংশ্লিষ্ট। এদেশের প্রধান তিমটি নদী পদ্মা, মেঘনা, যুমনা; এ তিনটি নদী। মানুষের অনাচার- অত্যাচার ফলে নদীগুলো বলা যায় মৃতপ্রায়। তাছাড়া উজান দেশের সঙ্গে ভাটির দেশ দেশের অনেক অমিমাংসিত বিষয় নিষ্পন্ন না হওয়ার ফলে এ দেশের নদীর ভবিষ্যত অন্ধকার বলা চলে। এদিকে তিস্তার পানি প্রবাহ ব্যাপকহারে কমে গেছে। পদ্মা, তিস্তা এখন মৃতপ্রায়, যুমনায় পড়েছে চর এর উপর চর। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতক্ষ্যা দখল ও দূষণের ভারে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে অনেকটা। এদিকে সারা দেশের অন্যান্য নদীগুলো দখল-ভরাটে নিস্তব্ধ, স্রোতহীন এবং দূষণের ভারে পানি ব্যবহারের অযোগ্য এবং জীববৈচিত্র শূন্য হয়ে পড়ছে সব নেদী প্রায়। ফলে বলা চলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ আজ মারাত্বক হুমকির সম্মুখীন। অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, বাঁধ নির্মাণসহ বাংলাদেশের উপর দিয়ে নদী বাহিত পলি প্রবাহের কারণে পানি সাগরে যেতে না পারায় অনেক নদীতে তলদেশ ভরে যাচ্ছে । কমে যাচ্ছে নদীর নব্যতা ও ন্যবনীয়তা। চোখ ঘেরিয়ে দেখলে বলা যায় দেশের প্রায় ১৪০ টি নদ-নদী এখন মৃত প্রায়। শুধু তাই নয় দেশের প্রায় ১৩টি নদীর অস্তিত্ব এখন বিলীনের পথে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন দেশের মানচিএ থেকে হারিয়ে যাবে এসব নদী।
জনসংখ্যা বাড়ার কারণপ, কৃষি জমির পরিমাণে কমছে। কৃষি জমি কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে বলে মনে করেন কৃষিবিদ রা। প্রতিবছর ৬৮,৭৩০ হেক্টর চাষাবাদ যোগ্য জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছেদেশে বর্তমানে ৮.৫৩ মিলিয়ন হেক্টর কৃষি জমি রয়েছে। ১৯৭৬ সালে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯.৭৬১ মিলিয়ন হেক্টর। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুর বৈশিষ্ট হারিয়ে প্রতিনিয়ত। এ কারণে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার আমুল পরিবর্তন ঘটছে সবখানেই।
জমির অতিকর্ষণে ভূমি ক্ষয় হচ্ছে দিন দিন। এদিকে দিন দিন টপসয়েলের আস্তরণ কমে যাচ্ছে। একই জমি বারবার চাষ করার ফলে অধিক ফলনের আশায়, অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশীয় ধানের জাত ১৯৮২ সালে ১২৩৮৭টি, ২০১৪ সালে ৭০৯০টি (বিএআরআই) রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে ইরি চাষের জন্য প্রচুর সেচের প্রয়োজন হয়। এতে ১২০০ থেকে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। সেচের পানি ভূ-গর্ভ ও ভূ-পৃষ্ঠ দু উৎস থেকেই আসে এবং খাল-বিল, নদ-নদী শুকিয়ে যাচ্ছে এ কারণপ। দেশের অনেক জায়গায় বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে সেচ কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিমাত্রায় উত্তোলনে এবং সেই র্ভূ-গর্ভস্থ পানির অপর্যাপ্ত পরিপূরণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আহরণ ক্ষমতার নীচে নেমে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ধারানা করা হয় দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিগত ৩০ বছর (১৯৮১-২০১০) বার্ষিক গড় ১.৩৯% হারে ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বেশি ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর সবচেয়ে বেশী নেমেছে রাজশাহীতে।
বলা যায়, বনজসম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী বৈচিত্র্যেও সমৃদ্ধ। সংশ্লিষ্ট কমপক্ষের মতে বাংলাদেশে ৯৮২ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিচরণ করে। যার মধ্যে ৫২ প্রজাতি উভচর প্রাণী, ১৫৯ প্রজাতি সরীসৃপ প্রাণী, ৬৫৬ প্রজাতি পাখি এবং ১২২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। উভচর প্রাণীর অধিকাংশই রয়েছে ভিণ্ন ভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ । গত শতাব্দীর আশির দশকের দিকে দেশর ব্যাঙের পা রপ্তানি করে কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়েছল। ব্যাঙ ক্ষতিকর ৪৫-৫০ ধরনের পোকা-মাকড় খেয়ে থাকে। সরীসৃপ প্রাণীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন গঠনের ৩০ প্রজাতির কাছিমের প্রায় সবগুলোই বিপনে তালিকায়। সচারাচর দেশে ২ প্রজাতির কুমির দেখা যায়। একটি হলো নোনা পানির কুমির, অপর টি ঘড়িয়াল। মিঠাপানির কুমির প্রায় দেশের কমবেশি সব নদীতে ছিল, যা বর্তমানে নেই বললে চলে বলা যায় বিলুপ্তির পথে । ধারণা করা হয় দেশে ১২ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে অচীরে এবং ৪৫ প্রজাতি স্তন্যপায়ী, ৪২ প্রজাতির পাখি, ৬৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩ প্রজাতি উভচর প্রাণী হুমকীর সম্মুখীন। গত ৪০-৪৫ বছরে মধুপুর শালবনের ৮৫ শতাংশের বেশি ধ্বংস করা হয়েছে। চিংড়ি চাষের নামে চকোরিয়া এলাকার ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, যা ক্ষতি করেছে অনেক বেশি।
বিশ্বের একক সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বলা হয় বাংলাদেশের সুন্দর বন’কে। বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, যা বসবাস করে বাংলাদেশের সুন্দরবনে। এদিকে এই রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের জাতীয় পশু এবং সুন্দরবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখছে অনেক বেশি। দেশের প্রায় ১২ লাখ এর বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা অনেকটা সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইক্লোন, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ, বনজ সম্পদের নির্বিচার আহরণ, বন্যপ্রাণী শিকার, ইত্যাদি কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন হতে চলছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববেচিত্র্যের এক অনন্য নিদর্শন বলা হয় সুন্দরবন কে। সুন্দরবনকে রক্ষা করে বাঘ (২০০৪ সালে ৪৪২টি, ২০০৬ সালে ২৫০টি, ২০১৫ সালে ২০৬টি)। আর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে এ দেশকে রক্ষা করে সুন্দরবন।
বাংলাদেশের হাওর এলাকা প্রায় ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটারপ (প্রায়)। সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সহ দেশের কয়েলটি জেলায় ৩৭৩টি হাওর/জলাভূমি রয়েছে। বলা যায় এ সকল হাওরের জৈব বৈশিষ্ট্যসমূহ দৃশ্যত অনন্য ও আকর্ষণীয়। তবল অতীতে হাওর অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র ছিল অতি সমৃদ্ধ যা দিন দিন এখন হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এদিকে পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে প্রাণবৈচিত্রের এই প্রাচুর্য বর্তমানে ক্রমক্ষয়িষ্ণু।
এদিকে রাজধানী ঢাকার নগরীতে অধিক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেই ভূগর্ভে পানির শূন্যতা ক্রমেই ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছ। মহানগরীতে যেখানে ১৯৭০ সালে ৬৯টি গভীর নলকূপ ছিল, বর্তমানে তা প্রায় ২০০০০টির অধিক। এদিকে বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছর পানির স্তর ১০ ফুট করে নিচে নামছে। ভূগর্ভে লবণ পানির অনুপ্রবেশ চলতে থাকলে ২০ থেকে ৩০ বছর পর মিঠা পানির অভাবে ঢাকায় জনশূন্যের পাশপাশি ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে মনে করেন পরিবেশবিধ গণ। ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল-এর পরিমান ছিল ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ২৯৫৪ ও ১৩৫২৯ হেক্টর, ১৯৮৮ সালে যথাক্রমে ২১০৬ ও ১২৭১৭ হেক্টর এবং ২০০৮ সালে যথাক্রমে ১৯৮১ ও ৬৪৩৫ হেক্টর। ১৯৬০ সাল হতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল যথাক্রমে ৩২.৬০% ও ৫২.৪০% হ্রাস পেয়েছে। জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট ও দখলের ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে আর নগরবাসী প্রতিনিয়ত জলাবদ্ধার শিকার হচ্ছে।
এসব সমস্যা দূর করতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া অতিব জরুরি।
১)পানি সম্পদ সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা অতি জরুরী।
২) নদ-নদী দখল-ভরাট- দূষণমুক্ত করা এবং খননের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধিপূর্বক পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো অতি জরুরী।
৩) যেসব এলাকায় পানির অভাব রয়েছে, সেসব এলাকায় ইরি চাষ পরিহার করে দেশীয় জাতের ধান চাষ করা অতি জরুরী।
৪)প্রকৃতি নির্ভর দেশীয় জাতের ধানের ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা অতি জরুরী।
৫) উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় মাছের চাষ করা এবং এসব মাছের ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা অতি জরুরী।
৬) নির্বিচারে বনভ’মি উজাড় রোধ এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা অতি জরুরী।
৭) ভ’গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি ব্যবহার করা অতি জরুরী।
৮)জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ পাহাড় ও হাওর প্রতিবেশব্যবস্থা সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতি জরুরী।